অনিয়মে জর্জরিত বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্প
দেশের উপজেলা পর্যায়ে উচ্চ গতির ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) গৃহীত প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে গৃহীত এ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য অপটিক্যাল ফাইবার বসানোর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা এবং সরঞ্জাম কেনার ব্যয় ৪৬৩ কোটি টাকা হিসেবে প্রাক্কলন করা হয়। সরঞ্জাম কেনার দরপত্রে প্রস্তাব দাখিল করে ৩টি কোম্পানি (জেডটিই কর্পোরেশন, হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেড এবং নোকিয়া সলিউশন)। অভিযোগ আছে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কেউই দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তবু কারিগরি কমিটি তাদের যোগ্য ঘোষণা করে।
অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ক্রয়
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১ টেরাবাইট পার সেকেন্ড (টিবিপিএস) ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করছে বিটিসিএল। এছাড়া ফাইভ-জি’তে নেটওয়ার্ক উন্নীত করলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত দেশে বিটিসিএলের ব্যান্ডউইথের চাহিদা কত হতে পারে তা নির্ধারণের জন্য বুয়েটের একটি কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ঐ কমিটি জানায়, ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিটিসিএল এর সর্বোচ্চ ২৬ টিবিপিএস ব্যান্ডউইথের চাহিদা হতে পারে। এরপর বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রফিকুল মতিন ও প্রকল্প পরিচালক মো. মনজির আহমদের যোগসাজশে ফাইভ-জি প্রকল্পের জন্য ২৬ টিবিপিএসের পরিবর্তে ১২৬ টিবিপিএস ব্যান্ডউইথের চাহিদা পূরণে সক্ষম সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য চুক্তি করে যন্ত্রপাতি ক্রয় সংক্রান্ত ৭ সদস্যের কমিটি, যা মূল খরচের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি।
এসব সরঞ্জাম ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিটিসিএলের ব্যান্ডউইথ সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে সক্ষম। অথচ এসব সরঞ্জামের আয়ুস্কাল সর্বোচ্চ ৭ বছর হতে পারে। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে পাল্টা অভিযাগ উঠলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রপাতি ক্রয়ের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে অতিরিক্ত যন্ত্রপাতিগুলো ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিটিসিএলের ব্যান্ডউইথ চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে বলে মতামত দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তিনি সংস্থার ২১৩তম পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করেন।
কারিগরি মূল্যায়নে অনিয়ম
ফাইভ-জি প্রকল্পের মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা সম্বলিত এক ধাপ দুই খাম পদ্ধতিতে আহ্বান করা আন্তর্জাতিক দরপত্রে ৩টি প্রতিষ্ঠান (জেডটিই কর্পোরেশন, হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেড এবং নোকিয়া সলিউশনস) দরপ্রস্তাব দাখিল করে। তবে ৩টি প্রতিষ্ঠানই আবশ্যিক চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিপর্যয়ে এএসওএন প্রযুক্তিতে নিরবিচ্ছিন্ন সব ব্যান্ডউইথ সঞ্চালনের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি কৌশলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ৩টি দরপত্রই যোগ্য হিসেবে মূল্যায়ন করেছে।
কারিগরি মূল্যায়নের প্রতিবেদন অনুমোদনে অনিয়ম
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) বাইরে মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা সম্বলিত দরপত্র দলিল বিবেচনায় এবং সঠিকভাবে কারিগরি মূল্যায়ন না হওয়ায় প্রতিবেদনটি অনুমোদন না করে দরপত্র বাতিল করেন বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আসাদুজ্জামান চৌধুরী। এছাড়া বাস্তবতার নিরিখে শর্ত, নকশা ও পরিধি সংশোধন করে দাফতরিক প্রাক্কালন পুনঃনির্ধারণ করে দরপত্রটি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের সিদ্ধান্ত দেন, যা মন্ত্রাণালয়ের ২০২৩ সালের মে মাসের এডিপি সভায় নিশ্চিত করা হয়। পরবর্তীতে সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান ও তার দুই সহযোগী যুগ্মসচিব মো. তৈয়বুর রহমান এবং প্রকল্প পরিচালক মো. মনজির আহমেদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাতিল করা দরপত্রটি স্থগিত করেন।
পরবর্তীতে তারা বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামানকে বিভিন্নভাবে দরপত্র অনুমোদনে চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু তিনি নতি স্বীকার না করে জেডটিই কর্পোরেশন, হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেডের অবৈধ ক্রয় প্রক্রিয়ার গোপন তথ্য সংগ্রহ ও দুটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্রই বাতিল করে দেন। দরপত্রগুলো বাতিল হওয়ায় আসাদুজ্জামানের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেন টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। পরে আসাদুজ্জামানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) থেকে সরিয়ে সাময়িক বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেন তিনি। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত আসাদুজ্জামানকে বরখাস্তের আদেশ ও মামলা স্থগিত করলেও তাকে বিটিসিএলে প্রবেশে বাধা দেন আবু হেনা মোরশেদ জামান।
অর্থিক মূল্যায়নে অনিয়ম
দরপত্র দাতাদের সব আর্থিক প্রস্তাব উন্মুক্ত করার পর ৭ সদস্যের মূল্যায়ন কমিটি ৩টি প্রতিষ্ঠানের কয়েকশ কোটি টাকার দরপ্রস্তাবের আর্থিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করা হয়। এরপর সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে হুয়াওয়ে টেকনোলজির পক্ষে ক্রয় প্রস্তাব দাখিল করা হয়। পরে যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঐ ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করে টেলিযোগাযোগ সচিবের পছন্দের প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে টেকনোলজিসের নামে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড জারি করে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ।
দুর্নীতিতে জড়িত যারা
১ হাজার ৫৯ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একনেক অনুমোদিত বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান। তিনি ও তার দুই সহযোগী যুগ্মসচিব মো. তৈয়বুর রহমান ও প্রকল্প পরিচালক মো. মনজির আহমদ এই ভয়াবহ দুর্নীতির মূল হোতা বলে চিহ্নিত হয়েছেন। এছাড়া ডিপিপির বাইরে অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দরপত্র দলিল প্রস্তুত করার জন্য দায়ী বিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. রফিকুল মতিন।
প্রকল্পের কাজ কতদূর
বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্পের ক্রয় সংক্রান্ত এলসি সম্পন্ন হওয়ার পর চলতি বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ফ্যাক্টরি টেস্টিংয়ের তারিখ নির্ধারণ করে হুয়াওয়ে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার বিষয়টি বিবেচনা করে ফ্যাক্টরি টেস্টিং স্থগিত করা হয়। এছাড়া টেলিযোগাযোগ সচিবসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য প্রকল্পের কাজ স্থগিত করা হয়েছে।